দাগ

ঋতু আর আমি আর আমাদের মেয়ে মূর্ছনা- আমাদের সংসার :আমাদের সংসারের বয়স দশ বছর পেরিয়েছে; পরিচিতজনেরা আমাদের সুখী বলেই জানে, আমরা নিজেরাও কি তাই জানতাম না- তো এর মধ্যে আচমকা একদিন ঋতু আমাকে জানায়- আমার মতো অনৈতিক আর অসৎ মানুষ সে তার জীবনে আর দেখে নাই- আমার সংস্পর্শে আমাদের শিশু মূর্ছনার ভবিষ্যৎ ছারখার হয়ে যাবে, তাই সে আলাদা বাসায় উঠতে চায়! আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি- ‘তুমি হয়তো ভুল বুঝতেছো আমাকে’; ঋতু আমাকে ‘ধুত্তুরি! তোকে ভুল বোঝার…’ আরও আরও বাজে কথা বলে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়- আমার মতো ভদ্রবেশী জোচ্চোরের সাথে সে তার মেয়েকে নিয়ে থাকতে পারে না।

ইংরেজিতে এমএ জোবেরা তাহের ঋতু নামি আন্তর্জাতিক সংস্থার পরামর্শক, মেয়েকে নিয়ে দিব্যি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বাড়ি ভাড়া করে আমাকে আরও বলে- আমি সেখানে কোনভাবেই যেতে পারবো না; মেয়েকে নিয়ে রেস্তরাঁয় সে আসবে, যদি মূর্ছনার সাথে দেখা করতে চাই!

বছর ঘুরে এলো- শুরুর দিকে মূর্ছনার জন্যে একটু বেশিই খারাপ লাগে আমার; পাঁচ বছরের শিশুটি ‘বাবা, বাবা’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে; মাসে দু’বারের বেশি আমার দেখা করবার সুযোগ থাকে না- এটাও ঋতুর তৈরি নিয়ম; সামনে এগোই- সময় এবং আমরা-ঋতু মাসে দু’বার থেকে মাসে একবার, পরে দুই মাস/ তিন মাস অন্তর রেস্তরাঁয় আসে মূর্ছনাকে নিয়ে, তা-ও ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গি-আমার সঙ্গে মূর্ছনাকে এক টেবিলে বসিয়ে দূরের টেবিলে বসে সে গম্ভীর মুখে কফি খায়; আচমকা উঠে এসে আমাকে রীতিমতো ধমকে দেয়- ‘কী আশ্চর্য! মূর্ছনাকে এতো বড় পেস্ট্রির টুকরো দিলে কেন? ও রাক্ষস নাকি!’

ঋতুকে কীভাবে বোঝাই, আমরা এখন পৃথক বাস করি! সে লোকচক্ষুর সামনে এভাবে আমাকে ধমকানোর অধিকার রাখে কি? অবশ্য ঋতুকে অধিকার দিতে হয় না। নিয়ে নেয়। সে অন্য বাড়িতে চলে গেছে- তাতে কী, যখন খুশি ঠিকই ফোন করে-

‘ব্যাপারটা কী? ফোন ধরতে এতো দেরি কেন?’

‘ওয়াশরুমে ছিলাম।’

‘মনে তো হয় না। নিশ্চয়ই তোমার পেয়ারের…’

‘কী বলতে ফোন করেছো সেটা বলো।’ ঋতুকে থামিয়ে দিই।

‘তোমার সাথে আবার কী বলবো? তোমার মতো একটা ছোটলোকের সঙ্গে আমি কী বলতে পারি…’

ঋতুর রাগ বরাবর বেশি- আমাকে ছেড়ে-দূরে চলে যাওয়া বউ, তাই তার নামে মুখভরে দুর্নাম গাইছি- ভাবা যুক্তিসঙ্গত হলেও এই যাত্রায় আমার কথা একেবারেই কানে নেয়া যাবে না, এমন নয়; কারণ, নিজের চরিত্রের খারাপ দিকগুলো নিয়েও আমি একইভাবে বলতে পারি।

আমার চরিত্রের সবচেয়ে খারাপ দিক- যে কোন বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা না করে মাঝপথে হাল ছেড়ে দেয়া!

এই যে ঋতু- দূরে যেতে যেতে সে বহুদূরে চলে গেল, মানসিক-শারীরিক দু’ভাবেই- এটা নিয়ে কিছু ভাবনা গভীরভাবেই ভাবতে চাই। কেন এমন হলো? ঋতুকে কি আমি ভালোবাসি না? অবশ্যই ভালোবাসি- ঋতুও এটা জানে; আর জানে বলেই সে আমাকে নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্যেই আলাদা বাসা নিয়েছে, ডিভোর্সের দিকে যায়নি; আমার ধারণা- যাবেও না। আমি নতজানু হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলেই সে মেয়েকেসহ ফিরে আসবে।

কিন্তু ক্ষমা প্রার্থনার ইচ্ছা করে না। বুঝি, ঋতুকে কষ্ট দিয়েছি; সে-ও আমার মতো আর কারু সঙ্গে কাণ্ড বাধালে আমার কি খারাপ লাগতো না! চিন্তা করলে ক্লান্ত হয়ে যাই। আমার মাথায় ঢোকে না ঋতু কীভাবে আবিস্কার করে অর্চনার ব্যাপারটা; আমি তো কোন চিহ্ন রাখি নাই কোথাও- মেসেঞ্জারে কথা বলেই সব ডিলিট করি। অর্চনার সাথে প্রকাশ্যে ঘোরাফেরাও করি না।

সুশাসন নিয়ে কাজ করে, এমন একটি বেসরকারি সংস্থার মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তা হিসেবে আছি গত এক দশকের বেশি- শুরু থেকে আমার কোন পদোন্নতি হয়নি, এমনকি এনজিও সেক্টরে আর কোন সংস্থা থেকে ডাকও পাইনি, নিজেও কারও সাথে যোগাযোগ করিনি; মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে আমার আপিস; নূরজাহান রোড থেকে ইকবাল রোডে বাসা-আপিস করি, ঋতুর সাথে আমার বিয়ে হয় পারিবারিক উদ্যোগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’জনে পড়লেও দু’জন ছিলাম দুই ফ্যাকাল্টির- বিয়ের আগে আমরা কেউ কাউকে চিনতাম না।

বিয়ের কিছুদিন পর আমার সম্পর্কে ঋতু অভিযোগ করতে শুরু করে। ঋতু বুঝতে চায় না, একেক মানুষ একেক রকম- সে সমানে আমার সম্পর্কে অভিযোগ করে; একবারও ভেবে দেখে না- আমি তার সম্পর্কে টুঁ শব্দ করি না।

‘কোন উচ্চাশা নেই, কোন ভবিষ্যৎ ভাবনা নেই- এ কেমন মানুষ তুমি মিনহাজ!’- রাগী কণ্ঠে ঋতু বলে।

নিস্পৃহভঙ্গিতে হাসি। দিনে দিনে তার কণ্ঠস্বর চড়ে- ‘মানুষের রাগ বলে যে একটা বস্তু্তু আছে, এটা তুমি জানো!…মানুষের অপমানবোধ বলে যে একটা জিনিস আছে, এটা তোমার জানা আছে ?’

চেষ্টা করি ঋতুর রাগ কমাতে।

‘আরে কী বলো! জানবো না কেন? রোজই তো অপমানিত বোধ করি।’

‘কখন? কখন অপমানবোধ হয় তোমার?’ ঋতু বলে।

‘এই যখন রিকশাওলারা তেজ দেখায়ে চলে যায়। হেঁটে হেঁটে অফিস যাই। তখন খুব অপমানবোধ হয়।’ পরিবেশ হালকা করবার চেষ্টা করি।

‘এই তোমার বুদ্ধি! চাকরিতে এক জায়গায় বসে থাকতে থাকতে গাছ হয়ে যাচ্ছো! তোমার হাঁটুর সমান ছেলেগুলো ঢাকা শহরে গাড়ি দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আর উনি নূরজাহান রোড থেকে ইকবাল রোডে হেঁটে যেতে অপমানিত বোধ করছেন!’

ঝনঝন করে বাজে ঋতুর কণ্ঠস্বর; এমনিতে ঋতু দেখতে বেশ- আমরা প্রায় সমবয়সী, আমার বয়স ৩৭, ঋতুরও কাছাকাছিই হবে; কিন্তু দেখলে ৩০-এর মতো মনে হয়; আর যা যত্ন নিতে পারে সে নিজের- এই চুল রঙ করা, এই জিমে যাওয়া, এই নতুন ইয়োগা মাস্টার…দেখবার মতো ব্যাপার। পেশাতেও ভালো করেছে ; কয়েক বছর এক ইংরেজি দৈনিকে অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বছর কয়েক টেলিকম হয়ে সে থিতু হয় আন্তর্জাতিক সংস্থায় কনসালট্যান্ট হিসেবে।

‘মরা মাছের মতো চেয়ে থাকো কেন?’ ঋতুর গলার স্বর শুনে মনে হয়, পারলে সে আমাকে ইকবাল রোডে আমাদের ভাড়া করা ছয়তলা বাসার ছাদে নিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেবে!

‘এভাবে রাগারাগি করলে হার্ট অ্যাটাক করবে। আমি বেশ আছি, বুঝলে?’ তখনও আমি হালকা হাসি।

‘তা তো বেশ থাকবেই। পুলাপানের মতো সারাদিন ফেসবুক আর মেসেঞ্জার…ছিঃছিঃ!’

আমি তাকে দোষ দিই না, এটাই স্বাভাবিক- সবাই চায় আরও একটু ভালো অবস্থায় যেতে; তা আমি কেন চাই না? আমি জানি না, আমার ভালো লাগে নিজের মতো কাজ করতে, আমাদের বস আতিউল আলম চমৎকার মানুষ; একদিন বললেন- ‘মিনহাজ! আপনি তো ডেস্ক ওয়ার্ক ভালো করেন। আপনাকে পেপার মনিটরিং কাজটি দিলাম।’

আমার পোয়া বারো হয়; আগে তা-ও মাসে, দুই মাসে একবার ঢাকার বাইরে সুশাসন পরিস্থিতি সরেজমিন দেখতে বিভিন্ন মফস্বল শহর কি গ্রামে যেতাম, পেপার মনিটরিং কাজ পাওয়ায় সেটাও আর করতে হয় না; আমি প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫টি দৈনিক ঘেঁটে দেশে সুশাসন সংক্রান্ত সংবাদগুলো কাঁচি দিয়ে কেটে কেটে ফাইল করতে থাকি।

‘ছি! ছি!…তুমি এই বয়সে এসে কাঁচি দিয়ে পেপার কাটার কাজ করতেছো? তোমার আক্কেল পছন্দ কিছুই নাই? তোমারে এরা কী পাইছে?’ ঋতু আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

‘আরে কী মুশকিল! তোমাকে বলাই তো ভুল হলো দেখছি। কাজটা আমার জন্য কত ভালো হলো বুঝলা না- কোথাও যেতে হচ্ছে না, মাথা খাটাতে হচ্ছে না…শুধু খবর পড়ো আর পেপার কাটো। কী চমৎকার!’

‘আচ্ছা, তোমার বেঁচে থাকার দরকারটা কী, বলো তো? বেঁচে থাকাও তো ক্লান্তিকর একটা ব্যাপার; না?’

আমি ঋতুর দিকে তাকিয়ে হাসি, শিশুদের দিকে তাকিয়ে বড়রা যেভাবে হাসে, ঠিক সেভাবে।

‘বিরাট হাসিদেনেওলা হইছো…!’ আর কথা খুঁজে না পেয়ে ঋতু সামনে থেকে উঠে চলে যায়। আমি মোবাইলে ফেসবুক দেখতে থাকি, আহ্‌- মানুষের কত শত মুখ, কত টুকরো টুকরো কথা! স্ট্ক্রল করতে করতে নিচের দিকে নামি আর নামি, আমার সময় কোন্‌ দিক দিয়ে চলে যায়, বুঝতে পারি না। এমনকি আপিসেও, পেপার মনিটরিং কাজ আর কতক্ষণের; এর পর ডেস্কটপেই ফেসবুক খুলে বসি, আতিউল স্যারকে বলি, পেপার মনিটরিংয়ের মতোই জরুরি এখন ফেসবুক মনিটরিং- দেশের সবচেয়ে দ্রুতগতির গণমাধ্যম এখন ফেসবুক- প্রতিদিনই কিছু কিছু রাজনৈতিক, সুশাসন সম্পর্কিত স্ট্যাটাস জড়ো করে প্রিন্ট দিই আতিউল স্যারের টেবিলে; তিনি ব্যস্ত মানুষ- সুশীল সমাজ আর রাজনীতির মতো দুই মহাজটিল বিষয়ে দিনরাত্রির ঘূর্ণনে থাকেন, তার সময় নেই ফেসবুক দুনিয়ার হালফিল খবর রাখা- আমি সেই কাজটি করি তার হয়ে। আমার সময় কাটে চোখের পলকে, রঙবাহারি দুনিয়ায়।

ঠিক এ রকম পরিস্থিতিতে বহু বছর পর অর্চনার সাথে আমার কথা হয় ফেসবুক মেসেঞ্জারে। অর্চনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার দুই ব্যাচ জুনিয়র, বহু আগে পাস দিয়ে সহপাঠীকে বিয়ে করে খুলনায় সুখে-শান্তিতে বসবাস করে। তার বর, রোমেল- আবছা মনে পড়ে ছেলেটিকে- দেখতাম কলাভবনে মাথা দুলিয়ে হাঁটতে; জানলাম- দুই বাচ্চা নিয়ে অর্চনা-রোমেল ভালো আছে, রোমেল-অর্চনা দুইজনই শিক্ষক- রোমেল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর অর্চনা খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির!

‘ওরে বাবা! ইঞ্জিনিয়ারিং? অর্চনা- এই শেষবেলায় অংক শিখলা কেমনে?’- মেসেঞ্জারে হাসির ইমোসহ মেসেজ লিখে পাঠাই।

‘শেষবেলা মানে! এসব কী বলেন মিনহাজ ভাই? উই আর স্টিল ইয়াং…আর…অংকে আমি কখনোই খারাপ না। তবে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ইংরেজি পড়ানো হয়। আমি তারই মাস্টার জনাব।’ অর্চনা উত্তর লিখে পাঠায়।

‘আচ্ছা।…তা ইয়াং টিচার, ছাত্রদের মাথা তো ভালোই খাচ্ছো মনে হয়!’

টুকটুক করে আমরা কথা বলতে থাকি; পনের বছর আগে শেষ চোখে দেখেছি অর্চনাকে- লম্বা মতন একহারা গড়নের মাথায় অনেক চুল, মনে পড়ে- আর মনে পড়ে, ওর শরীরটা বড় সুঠাম ছিল- যেন ধনুকের টান টান ছিলা, আর হেঁটে যেত সগর্বে- রাজহাঁসের মতো মাথা উঁচু করে।

ক’দিন পর মেসেঞ্জারে নক করি অর্চনাকে।

‘এই যে রাজহাঁস! আছো কেমন?’

‘রাজহাঁস! রাজহাঁস মানে?’

‘কলাভবনের করিডোর ধরে যখন তুমি হেঁটে যেতে, মনে হতো- আস্ত একখানা রাজহাঁস হেটে যাচ্ছে।’

‘ওরে বাবা! কী রোমান্টিসিজম! তা তখন বলেন নাই কেন জনাব?’

‘বুঝি নাই।’

‘বুঝি নাই মানে!’

‘তখন তো আরও কত কী মনে হতো, সব কি বলা যায় নাকি?’

‘আর কী মনে হতো; শুনি একটু।’

‘থাক।’

‘থাকবে কেন? বলেন শুনি।’

‘কিছু মনে করতে পারবা না..’

‘মনে করবো না।’

‘কসম।’

‘কসম’- অর্চনার মেসেঞ্জারে ‘কসম’ শুনে আমি মেসেঞ্জারে লিখে পাঠাই- ‘তোমার টানটান শরীরটা দেখলে মনে হতো জামা-টামা ভেদ করে সব বোমার মতো বের হয়ে আসবে!’

কথা নাই; সাড়া শব্দ নাই।

নিজের উপর রাগ হয়; আসলেই কথার লাগাম নাই আমার!

‘এতোদিন পর এই কথা! তখন তো মেনি বেড়ালের মতো মাথা নিচু করে রাখতেন। আছে, আছে- আমারও কিছু মনে আছে জনাব!’- নাহ, রাগ করেনি অর্চনা; মেসেঞ্জারে তার লেখা এই বার্তা জ্বলজ্বল করে আমার চোখের সামনে।

‘তখন এই কথা বললে কী হতো?’ আমি জিজ্ঞেস করি।

‘কিছুই হতো না। জুতার বাড়ি খেতেন! পরে জুতা কামড়ে কামড়ে খাইতেন আপনি; আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম!’

‘একি! তুমি গালাগালি করছো আমাকে?’

‘না, গালাগালি করবো না? ভণ্ড একটা…।’

‘কিসের ভণ্ড? তোমাকে ভাবলে তোমার সেই টাইটফিট ঠিকরে পড়া শরীর মনে পড়ে। আমার কী দোষ?’

‘চল্লিশ হইছে আপনার?’- অর্চনা মেসেঞ্জারে লিখে পাঠায়।

‘কাছাকাছি।’

‘এরে কয় চল্লিশের ছেনালি! সব ফালায়া শরীর…শরীর!’

‘শরীর…শরীর.. তোমার মন নাই কুসুম!’

আর তারপর বিস্ময়ের ঘোরে দেখি, আমরা- অর্চনা আর আমি কথা বলতে থাকি- মেসেঞ্জার ঝরে পড়ে, আমরা ফোনের এপ্রান্ত ওপ্রান্তে কথা বলতেই থাকি; অর্চনা তার গল্প করে, আমি করি আমার গল্প…

‘শোনেন। আমি না ভুলেই গেছিলাম…কথা বলতে এতো ভালো লাগে!’

‘কেন? তুমি কথা বলো না বুঝি!’ আমি জিজ্ঞেস করি।

‘বলিতো। সব কাজের কথা। বিনা কারণে এতো কথা বলা যায়, তাতো ভুলেই গেছিলাম।’

‘অ। তার মানে আমি ফালতু!’ আমার কণ্ঠে রাগ।

‘ফালতু আবার কখন বললাম?’ অর্চনার কণ্ঠে বিষ্ফ্ময়।

‘আমার সাথে কথা বলা বিনা কারণ?’

‘আহারে, তাই বলছি বুঝি! আশ্চর্য!’

আমরা অভিমান করি, আমরা রাগ করি।

সারাদিন হয়তো ফোন করা হয় না একদিন কিংবা মেসেঞ্জারে নক করাও হয় নি কোন একদিন…অর্চনা অভিমান করে।

ফোন করি। অর্চনা ফোন রিসিভ করে না। কেটে দেয়। একবার, দুইবার, তিনবার। অর্চনা ফোন ধরে।

‘এতোক্ষণে বাবুর সময় হলো! বুঝছি। আমি আপনার অবসর বিনোদন!’ অর্চনা কণ্ঠস্বরে মেঘ জমিয়ে বলে।

‘কি যে বলো না তুমি! কিসের অবসর বিনোদন। টুকটাক কাজতো আমারও থাকে নাকি!’

‘হুম…এখন কত কাজের লিস্টি বের হবে। জানিতো।’

‘কচু জানো। তোমার সাথে কথা না বলতে পেরে…’

‘থাক। আর মিথ্যার ফোয়ারা ছোটাতে হবে না!’

আমরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করি।

‘অর্চনা তোমাকে নিয়ে আমার প্রিয় নদীর কাছে যবো একদিন!’ আমি বলি

‘কোন প্রিয় নদী?’ অর্চনা জানতে চায়।

‘আছে, আছে। আমার নিজের একটা নদী আছে। সেই নদীর পাড়ে একটা গাছ আছে। গাছটাও আমার। ওখানে তুমি- আমি বসবো একদিন। অনেকক্ষণ।’

‘বসে বসে আমরা কি করবো?’

‘পাশেই একটা গ্রাম আছে। ওখানে নারিকেলের নাড়ূ পাওয়া যায়। আমার ছেলেবেলার সবচেয়ে প্রিয়। নদীর পাড়ে গাছের নিচে বসিয়ে তোমাকে আমি সেই নারিকেলের নাড়ূ খাওয়াবো। ‘ আমি বলি।

‘আর কিছু না!’ অর্চনা বলে আর হাসে।

‘আরও আরও …আরও অনেককিছু…!’ আমি রহস্য করি।

আমাদের কি বয়স কমে যায়? আমরা জানি না।

দিনের বেশির ভাগ সময়, যতক্ষণ সম্ভব হয়, তারও চেয়ে বেশি কথা বলি আমরা- রাতে সম্ভব হয় না; ঋতুর সবকিছু নিয়ম-মানা, রাত ১১টার মধ্যে সে বিছানায় যাবে, আমাকেও যেতে হবে, মূর্ছনাকে মাঝে রেখে আমরা ঘুমোনোর চেষ্টা করি; মাঝেমধ্যে মূর্ছনা ঘুমিয়ে গেলে ঋতুকে ডাকি; সে বিরক্তিভরা কণ্ঠে বলে, ‘আজ কি বিষ্যুদবার?’

‘না তো। রোববার।’

‘তাইলে ডাকলা কেন? জানো না…বিষ্যুদবার ছাড়া আমি পারি না। সকালে অফিস লেট হয়।’ বলে পাশ ফিরে ঘুমোয় ঋতু।

আমার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে মৃত পাখির মতো পড়ে থাকে।

মৃত পাখির মতো এরকম পড়ে থাকবার ঘটনা দিন দিন বাড়ে।

বলবো না বলবো না করেও একদিন কথায় কথায় অর্চনাকে বিষ্যুদবারের দাম্পত্যের কথা বলে বসি; অর্চনাও তার কথা বলে- ‘গত দেড় বছর ধরে মনে হচ্ছে রোমেলের শরীরে কোন তাপ নেই। ডাক্তারের কাছে গেছি আমরা। ডাক্তার কাউন্সেলিং করে ওষুধপত্র দিয়েছেন।’

‘এটা কেন হয়? দিনের পর দিন এক সাথে থাকতে থাকতে? একঘেয়ে লাগে?’ আমি জিজ্ঞেস করি অর্চনাকে।

‘এক সাথে থাকলে বুঝি শুধু একঘেয়েমিই আসে! শরীরের ওই সম্পর্কটা তো আছেই…তারপর কত আপদ-বিপদে পাশাপাশি…কত ছোট ছোট সুখ আর দুঃখের সঙ্গী..কথা বলে বা না-বলে… এটাই তো সবচেয়ে নিবিড় সম্পর্ক…’

ফোনে কথা বলছিলাম; আপিস বারান্দায় দাঁড়িয়ে, অর্চনার কথায় আমার সারাটা শরীর হিংসায় জ্বলতে থাকে; আগে কখনও এমন অনুভূতি হয়নি আমার- দেখতে পাই, রোমেলের বুকে মাথা দিয়ে কুটুর কুটুর গল্প করে অর্চনা, রাগ উঠে যায় আমার-

‘খুব প্রেম, না? বুকের মধ্যে মাথা দিয়ে কুটুর কুটুর প্রেমের গল্প করা হয়?’

‘তা তো করবোই। করবো না কেন? তুমি করো না?’- অর্চনা বলে, আমরা ততদিনে আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসি।

‘আমি মোটেই করি না। তুমিই করো।…আর সেটা আমার সহ্য হচ্ছে না।’

হিহিহি করে হাসে অর্চনা। ‘তোমার পাশে তোমার বউকেও আমার সহ্য হয় না।’

‘এর চিকিৎসা কী?’ আমি বলি।

‘এর চিকিৎসা হলো…আর যোগাযোগ না করা। অসহ্যবোধ আরও বেশি হওয়ার আগে নিজেদের শান্ত করা।’

‘হ। তরে কইছে? আমরা তো মেশিন? ইচ্ছা হলো চাবি দিয়া স্টপ করে দিলাম।’ বলতে বলতে উত্তেজনায় কাঁপি আর ভাবতে থাকি, খুলনায় গিয়ে কীভাবে অর্চনার সাথে দেখা করা যায়! বলি- ‘আমি খুলনা আসতেছি। আমার সাথে অনেক… অনেকক্ষণ সময় নিয়ে দেখা করবা!’

টেলিফোনের ওপাশে কেঁপে ওঠে অর্চনা- ‘খুলনায় না। এখানে ছোট জায়গা। সবাই সবাইকে চেনে। আমি একা আসবো ঢাকায়।’

‘কবে?’

‘আসবো। জানাবো।’

অর্চনা মাঝে মধ্যে ঢাকা আসে; ঢাকায় তার সাথে বর-বাচ্চার বহর থাকে, আমাদের সামান্য সময়ের জন্য দেখা হয়- বড়জোর আধঘণ্টার জন্য মিরপুরে বড় আপার বাসা থেকে ইকবাল রোডের দিকে আসে অর্চনা। আমরা এদিক-ওদিক বজ্রাহত পাখির মতো ঘুরি- একটুখানি চুমু খাওয়া- হুলস্থূলের মধ্যে এর চেয়ে আর বেশিদূর এগোনো দুঃস্বপ্নের ব্যাপার। প্রথম যেদিন চুমু খাই অর্চনাকে- আমার সারা শরীরে লাখখানেক ভোল্টের বিদ্যুৎ বয়ে যায়; ৩৭ বছর বয়সেও সদ্য তরুণের মতো অন্ধকার কফিশপের এক কোনায় অর্চনাকে জড়িয়ে ধরে থরথর করে কাঁপি- অর্চনাও তাই- মনে হয় এই তার প্রথম। আহ্‌- ইচ্ছা হয়, একদৌড়ে চলে যাই অর্চনার কাছে।

আমাদের কথা চলতে থাকে, চলতেই থাকে; এতো যে কথা আমার বুকের মধ্যে ছিল- আমি জানতামই না; নাকি, আলসেমি- কাজকর্ম বাদ দিয়ে প্রেমের নামে নিজেকে ভুলে থাকতে চাই! সুশাসনের খোঁজে সত্যিই যদি মাঠেঘাটে কাজ করি, তাহলে তো আর সারাদিন যখন-তখন কথা হয় না!

এর মধ্যে ঋতু বারবার জিজ্ঞেস করতে শুরু করে- ‘তোমার কী হইছে? কী এতো ভাবো সারাদিন?’

কথা বলি না।

বৃহস্পতিবারের রাতগুলোও আমার আর ঋতুর মধ্য থেকে হারিয়ে যেতে থাকে। একদিন ঋতু আমাকে বলে- ‘তোমার মতো অনৈতিক আর অসৎ মানুষ আমি আর দেখি নাই।’

মাথা নিচু করে থাকি।

‘কথার উত্তর দাও না কেন?’ ঋতু জিজ্ঞেস করে।

‘কী উত্তর দেব?’

‘এই অর্চনাটা কে? সারাদিন যার ধ্যান করো!’ দেখি, নিজের মোবাইলে অর্চনার প্রোফাইল খুলে তা দেখিয়ে ঋতু আমাকে বলে।

ঋতু কয়েক দিন পর ইকবাল রোডের বাসা ছেড়ে মূর্ছনাকে নিয়ে বসুন্ধরার বাসায় ওঠে।

অর্চনাকে আমি বলি, ‘অর্চনা? আসবে না তুমি? নাকি আমি আসবো?’

‘সারাদিন এক আসো আসো ছাড়া তোমার কথা নাই! তোমার কোন ব্যক্তিত্ব নাই?’ অর্চনা আমাকে বলে।

‘এখানে ব্যক্তিত্বের কী আছে! তুমি আসবা কি-না বলো!’

‘তুমি আমার সাথে কোন যোগাযোগ করবা না! ‘

‘কেন? কী হইছে?’ সত্যিই বিস্ময়ে আমার কথা প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম।

‘তোমার জন্য আমার সংসারে অশান্তি হয়। আমি চাই না আমার বাচ্চারা তাদের বাবা-মার কুৎসিত ঝগড়া দেখে বড় হোক… তোমাকে নিয়ে রোমেলের সঙ্গে আমার জঘন্য ঝগড়া হয়।’ ফোনের ও-প্রান্তে ঝরঝর করে কাঁদে অর্চনা।

প্রেমে পড়লে মানুষ এমন কিছু আচরণ করে, যাতে চারপাশ বুঝে যায়- তার জীবনে কিছু একটা ঘটে গেছে! বোকা মেয়ে অর্চনা; বরের হাতে ধরা খেয়েছে নিশ্চয়ই।

কিন্তু ঋতু কীভাবে টের পেল আমারটা! আমিতো কোথাও কোনো দাগ রাখি নাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published.