জীবিত ও মৃত

আমরা যখন ফুলবাড়িয়ায় পৌঁছি তখন মধ্যরাত পেরিয়ে যায়; সংবাদটি আসে সন্ধ্যার পর, আমাদের পত্রিকা অর্থাৎ দৈনিক দেশমাটি পত্রিকার ফুলবাড়িয়া প্রতিনিধির ফোন আমরা ঢাকায় বসে পাই, খ্যাতনামা ব্যবসায়ী মোনতাজ আখন্দ ফুলবাড়িয়ায় নিজের বাড়িতে দিনের যেকোনো সময় নিহত হয়েছেন, সঙ্গে নিহত হয়েছেন অজ্ঞাতনামা এক সুন্দরী তরুণী- দেশের নামি ব্যবসায়ী, নিজ গ্রামের বাড়িতে; আবার কারও কারও মতে- নিজের বাগানবাড়িতে অপরিচিতা তরুণীসমেত নিহত; দেশের সবক’টি টেলিভিশনের স্ক্রলে শীর্ষ ব্যবসায়ী মোনতাজ আখন্দসহ নিহত ২ সম্প্রচার হতে শুরু করে, খুনের খবর আজকাল আর এক্সক্লুসিভ নয়; তবে মোনতাজ আখন্দ দেশের অন্যতম ধনী- তিনি আকস্মিক নিহত, উপরন্তু তার সঙ্গে নিহত আরেক সুন্দরী তরুণী- কেবল স্থানীয় প্রতিনিধির কলমে চাঞ্চল্যকর এই খবর প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপার ভরসা করে উঠতে পারেন না পত্রিকা কর্তৃপক্ষ; তাই খবর পাওয়া মাত্র আমরা, কতিপয় পত্রিকা ও টেলিভিশনের সাংবাদিক, আলোকচিত্রী ফুলবাড়িয়া অভিমুখে ভাগাভাগি ভাড়াকরা এক মাইক্রোবাসে রওনা দিই। এমন হয় কখনও কখনও; ঢাকা থেকে দূরবর্তী অঞ্চলে একই বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরির উদ্দেশ্যে আমরা বিভিন্ন পত্রিকা ও টেলিভিশনের সাংবাদিকেরা একযোগে কি এক পরিবহনে যাওয়া-আসা করে থাকি; এতে অর্থনৈতিক সাশ্রয়সহ নানা ধরনের সুবিধা হলেও আজ একটু বেকায়দা হয়ে যায়।

দুই টেলিভিশনের চারজনের ইচ্ছা মৃতদেহ যেহেতু ফুলবাড়িয়া উপজেলার হাসপাতালে এখনও আছে, সেখানেই মাইক্রোবাস আগে যাবে; আর ২ পত্রিকা থেকে আসা আমাদের প্রবল চেষ্টা, যেভাবেই হোক শুরুতে আমাদের থানায় যেতে হবে; পত্রিকা ছাপানোর নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকে, ইতোমধ্যে রাত ১২টা পেরিয়ে গেছে; টেলিভিশনওলারা আমাদের যুক্তির তোয়াক্কা করে না, তারা বলতে থাকে, অন্য টেলিভিশন এসে গেছে, এখনই লাইভ দেখাতে শুরু করবে, তাড়াতাড়ি হাসপাতালে গিয়ে আমরা লাইভ প্রচার করতে না পারলে আমাদের চাকরি চলে যাবে!

ময়মনসিংহ সদর থেকে ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে ফুলবাড়িয়া উপজেলা বরাবর চলাচলের রাস্তা অপরিসর হলেও পাকা রাস্তায় কোনো বাতি কি আলোর ব্যবস্থা নাই, রাস্তার দু’ধারে ধু-ধু বিস্তৃত জমিতে অবারিত ধানের ক্ষেত, যতটুকু চোখ যায়, ঘন অন্ধকারেও আমরা বুঝতে পারি, এখানে ফসলের সমারোহ সুপ্রচুর- একখানা ছোট ব্রিজ পাড় হই, ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে যায় চুলের সিঁথির মতো এক নদী; কিছুদূর এগোলেই ফুলবাড়িয়া বাজার, এখানে রাত বারোটার পরও এখন চায়ের দোকানে উপচেপড়া ভিড়, তরুণ থেকে বৃদ্ধ, চৈত্র্যের ভ্যাপসা মধ্যরাতে তারা উত্তপ্ত আলোচনায় আক্ষরিক অর্থেই চায়ের কাপে ঝড় তোলে; আমরা জেনে যাই, পেরিয়ে আসা চুলের সিঁথির মতো নদীটির নাম বানার; আর কিছুদূর এগোলেই থানা, তবে হাসপাতাল এখান থেকে কিছু দূরের পথ বটে; কাজেই থানা বনাম হাসপাতাল- আমাদের তর্ক বাড়ে ও আমরা পত্রিকার ৪জন- ২ পত্রিকার ২ সাংবাদিক ও ২ ফটো সাংবাদিক মাইক্রোবাস থেকে ফুলবাড়িয়া বাজারের চায়ের দোকানে নেমে যাই; টেলিভিশনওলারা হাসপাতালের দিকে বাহন ঘোরায়।

হাঁটাপথে বাজার থেকে থানা ১০ মিনিটেরও কম পথ, রিকশায় আরও কম, আমরা নিকটবর্তী চায়ের দোকানে দাঁড়াই ও আমাদের চিনি ছাড়া চা ও টোস্ট বিস্কুট দিতে বলি, কেউ কেউ সিগারেট ধরাই। দোকানের অভ্যন্তরে তখন আজকের ঘটনার উত্তপ্ত পর্যালোচনা চলে:

‘মিয়া, চুরের দশদিন, আল্লার একদিন। সইবো না। সইবো না। দ্যাহো, নগদে বিচার পায়া গেল!’- এক প্রৌঢ় সজোর মতামত দেয়।

‘কি চুর, চুর করতাছুইন! মোনতাজ মিয়া আমাগোর দ্যাশের কয়শ’রে চারকি দিছে। এট্টু খিয়াল কইরা কথা কয়ো…। হেই ব্যাডা এমুন কইর‌্যা খুন হইবো! ইটা কেমুন কথা?’- আরেক প্রৌঢ় মোনতাজ আখন্দের পক্ষে বলতে থাকে।

‘হ। চারকি দিছে বইলা গেরামের মইদ্যে ফূর্তির ঘর বানাইবো! মায়া লুক লয়া থাকবো। এইবার বুঝো! ফুট্টুস!’- বলতে থাকে আরেকজন।

‘আরে তুমরা পলিটিক্স কিচ্ছু বুঝো না। মোনতাজ মিয়া ইলেকশন করবার চায়ছিল। তাই শ্যাষ হয়া গেল!’-যিনি বলেন এই কথা তার চেহারা শিক্ষকের মতো।

‘ভাই, নিউজ পাঠাইবেন না!’- আমাদের তাড়া দিতে থাকেন দৈনিক দেশমাটির স্থানীয় প্রতিনিধি হারুনুর রশীদ, আমার দিকে তাকিয়ে বলেন- ‘আপনের বেশি কষ্ট করতে হইবো না। আমি লিইখা রাখছি। আপনে সবার সাথে কথা কয়া ক্রস করবেন খালি।’ আমরা ফুলবাড়িয়া থানার দিকে এগোই, বাজার থেকে থানা বরাবর রাস্তায় এতো রাতেও অগণিত মানুষ হেঁটে চলে, তারা কথা বলতে থাকে জোড়া খুন নিয়ে, তাদের চোখে মুখে বিস্ময়, অবিশ্বাস ও কৌতূহল, হাঁটাপথে যেতে যেতে কারও কারও সজোর বিশ্লেষণ শুনতে থাকি : ‘এইডা কুনো কথা হইলো। ঢাকা থিকা সিকিউরিটি ফোরসের লুকেরা বাগান বাড়িত গার্ড দেয়। মোনতাজ মিয়ার কালা গাড়ির আগে-পরে বন্দুকওলা খয়েরি গাড়ি হে’রে পাহারা দিয়া আনিগুনি করে। হেই বেডা বান্ধবী লয়া ঘরের ভিতরে খুন হইলো! কেমনে!’

থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার মোজাফ্ফর হোসেনের বয়স পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি, শক্ত শারীরিক কাঠামো, মুখে বসন্তের দাগ, কালো গায়ের রঙ, চোখগুলো বড় বড় হওয়ায় তার মুখে দ্রুত ও সহজে অসহায় ভাব প্রকাশ পায়; মোনতাজ আখন্দের খুন ও এর পরবর্তী ঘটনাপরিক্রমায় মোজাফফর হোসেনের মুখ আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়ে। মোজাফফর জানতেন, মোনতাজ আখন্দ দেশের খুব বড় ব্যবসায়ী, তার প্রচুর সম্পদ, ঢাকাসহ বিশ্বের নানা জায়গায় তো বটেই, জন্মগ্রাম ফুলবাড়িয়ায় তার কয়েকশ একর জমি, বাগানবাড়ি ইত্যাদি আছে; ফুলবাড়িয়ার কয়েক হাজার মানুষকে তিনি আশুলিয়া কি গাজিপুরে তার কারখানায় শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন; তার টাকার সীমা নাইÑ কিন্তু মোনতাজ আখন্দ যে এতো প্রভাবশালী মানুষ ছিলেন, এটা মোজাফ্ফর আগে বুঝে উঠতে পারেন নাই; আমাদের সঙ্গে তার কথাবার্তায় এমনই মনে হতে থাকে:

‘মোজাফ্ফর সাহেব। আপনি এতো ঘামছেন কেন? খুন-খারাবি তো হবেই। পুলিশ কি বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাহারা দেবে নাকি? আপনি ঘাবড়ে গেছেন মনে হচ্ছে!’-আমাদের একজন মোজাফ্ফর সাহেবকে বলে।

‘ঘাবড়াই নাই ভাই। টেলিভিশন ক্যামেরা ফেস করি নাই কখনও! তাই নার্ভাস আছি!’ তিনি ম্লান হাসেন ও বলেন- ‘আমার স্যার চলে আসছেন ময়মনসিংহ থেকে, তিনিই কথা বলবেন আপনাদের সাথে।’ ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার আবু বক্কর ছিলেন হাসপাতালের মর্গে লাশের কাছে, তিনি থানা আপিসে এলে যেন সাহস ফিরে পান মোজাফ্ফর; চিফের পাশে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের নিজেই একটানা বলতে থাকেন, ‘মোনতাজ আখন্দের বাড়ি থেকে মাগরেবের নামাজের সময় থানায় ফোন আসে । হেড দারোয়ান রহিম জানায়, তাদের স্যারসহ আরেকজনের মৃতদেহ বাড়ির ৩ নম্বর বেডরুমে পাওয়া গেছে। সঙ্গে সঙ্গে আমরা মুভ করি সেখানে। লাশ উদ্ধার করে হাসপাতালে রাখি। সুরতহাল করি।’

একটু আগের নার্ভাস মোজাফ্ফর সাহেবকে আর নার্ভাস মনে হয় না; বলতে থাকেন- ‘মোনতাজ আখন্দের স্ত্রী ও ১ সন্তান হেলিকপ্টার নিয়ে আসতেছেন; ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তারা লাশ নিয়ে ঢাকায় ফিরে বারডেম হাসপাতালের হিমঘরে রাখবেন। আরেক সন্তান আমেরিকা থেকে ফিরলে তার লাশ দাফন হবে। এখানে তদন্তের কাজ চলছে। বাগানবাড়ির হেড দারোয়ান রহিমসহ ৫ জন গার্ড ও ৫জন কর্মীকে গ্রেপ্তার করে থানা হাজতে রাখা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। ’

‘সুরতহাল রিপোর্টে কি পাওয়া গেছে?’- আমরা প্রশ্ন করি।

‘বিষ প্রয়োগে মৃত্যু। দুইজনকেই খাবারে বিষ প্রয়োগ করে খুন করা হয়েছে। মৃত্যুর ৩/৪ ঘণ্টা আগে মানে দুপুরের খাবারে বিষ প্রয়োগ করা হয়। দুইজনের মৃত্যুও হয় কাছাকাছি টাইমে।’

‘আপনারা নিশ্চিত যে, এইটা মি. মোনতাজের বাগানবাড়ি ছিল?’ আমরা প্রশ্ন করি।

‘ভাইরে..বাগানবাড়িতে তো আর সাইনবোর্ড থাকে না। তবে বিশাল বাড়ি, সুইমিংপুল, হরিণ-টরিন আছে, সারাবছর খালি পড়ে থাকে। দারোয়ানরাই থাকে। মাঝেমধ্যে কেউ কেউ এসে থাকেন। তাই সাধারণভাবে এইটারে বাগানবাড়িই বলা যায়। এই বাড়ি সাতমাথা গ্রামে বানার নদীর তীরে। উনার মূল বাড়ি আরও ১০ কিলোমিটার দূরে নদীখালিতে। ঐটা এখন ৩ তলা বাড়ি। সেখানেও কেউ থাকে না। কেয়ারটেকার আছে।’- আবু বক্কর বলতে থাকেন।

‘সাথের তরুণীটি কে?’ আমরা প্রশ্ন করি।

‘এখনও তার পরিচয় আমরা জানতে পারি নাই। তবে আমরা তার পরিচয় জানার চেষ্টা করছি।’

রীতিমতো সাংবাদিক সম্মেলন করে উঠলেন পুলিশের দুই কর্তা আবু বক্কর ও মোজাফফর হোসেন এবং বললেন, ‘এর বেশি দেবার মতো তথ্য আপাতত আমাদের হাতে নাই।’

থানা-পুলিশ-হাসপাতাল-স্থানীয় ছাত্রনেতাদের কাছে দৌড়-ছোটাছুটি আমাদের চলতে থাকে; এরমধ্যেই যার যার পত্রিকার জন্যে রিপোর্ট আমরা পাঠিয়ে দিই তবে আমরা বিস্মিত হতে থাকি দেখে যে, থানার কেউই তরুণীটির পরিচয় দূরে থাক, তার লাশের কি গতি হবে, তা নিয়েও আদৌ চিন্তিত নয়। তরুণীর লাশ ফুলবাড়িয়া হাসপাতালের মর্গেই থাকে, যেমন থাকে মোনতাজ আখন্দের মৃতদেহ; তবে আমরা বুঝতে পারি, স্থানীয় পলাশিহাটা উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে যে হেলিকপ্টার কিছুক্ষণের মধ্যে নামবে সেটি কেবল মোনতাজ আখন্দের দেহটিকেই তুলে নিয়ে যেতে আসছে। আমরা ওসি মোজাফ্ফরকে জিজ্ঞেস করি- ‘তরুণীর লাশ কি এখানেই পড়ে থাকবে নাকি! হেলিকপ্টারে করে তরুণীকে নিতে অসুবিধা কোথায়?’

‘ভাইরে, এইটা পারসোনাল এরেঞ্জমেন্টে হচ্ছে। মোনতাজ আখন্দের ফ্যামিলি এই মেয়েকে নিবে না। বোঝেন তো আপনারা…সামাজিকতা বলে একটা ব্যাপার আছে; আমরা পুলিশের গাড়িতে তরুণীর লাশ ঢাকায় পাঠাবো। ময়মনসিংহ থেকে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স রওনা দিছে অলরেডি’- আবু বক্কর আমাদের জানান।

রাত গভীর হতে থাকে; আমরা পলাশিহাটা স্কুলের মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি, ক্রমাগত মানুষের সংখ্যা বাড়ে, শিশু-বৃদ্ধ-তরুণ-তরুণী বিভিন্ন বয়সের মানুষ ভিড় জমাতে থাকেন, চাঁদের আলো ছিল না তখন, ঘুটঘুটে অন্ধকার, এরমধ্যেও অজ¯্র মানুষের ভিড়ে কেমন যেন আলোকিত হয়ে যায় চারপাশ, উৎসাহী যুবকের দল কাঠের টুকরো জড়ো করে কেরোসিন জ্বালিয়ে আলোর ব্যবস্থা করে স্থানে স্থানে, সবমিলিয়ে রীতিমতো উৎসাহ-কৌতূহল আর উত্তেজনাকর এক পরিস্থিতি তৈরি হতে থাকে। তরুণরা জড়ো হয়ে গুঞ্জন করতে থাকে- ‘লাশ দুইখান। একটা হেলিকপ্টারে যাইবো। আরেকটা পইড়া থাকবো; তা কেমনে হয়! নিলে দুইডারে নিওন লাগবো।…আর এই মাইয়া কেডা…এইডাও আমরা জানতে চাই।’ গুঞ্জন রীতিমতো প্রতিবাদের আকার পায়, ‘খুন কেমনে হইলো; কেডায় করলো, বিত্তান্ত কি-হেইডাও আমাগোর কইতে হইবো।’ আমরা লক্ষ্য করতে থাকি, ফুলবাড়িয়া কলেজের কিছু ছাত্র নেতৃত্ব নিয়ে নিজেদের হাতে নিয়ে নেয় ও জটলা মিছিলের আকার ধারণ করে; আরও লক্ষ্য করি, পুলিশের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে, সম্ভবত আরও কয়েক ব্যাটেলিয়ন পুলিশ চলে আসে আশপাশের এলাকা কি জেলা থেকে।

শুনতে পাই, লোকজন বলাবলি করছে, ‘এই হেলিকপটার নামলো বইলা… দেহি কেমনে এট্টা লাশ লয়া যায়…’

হট্টগোলের মধ্যে স্থানীয় এমপি, মেম্বর ইত্যাদি নেতা গোছের কয়েকজনকে দেখা যায়, ছাত্রদের বোঝাতে শুরু করেন- ‘এইটা আমাদের এলাকার মান সম্মানের বিষয়। এগুলা নিয়া বেশি ফালাফালি করিস না। পত্রিকায় বদনাম হয়া যাবে। মানী মানুষের মান রাখা আমরার কাম।’

‘মানী মানুষ কারে না কারে লয়া ফূর্তি করতে গিয়া মইরা গেল! হের মান নাই….মান সক্কলেরই আছে। আমরা তো আর কিছু চাই না। ওই মেয়ের লাশ একলগে নিতে হইবো।’ ছাত্রদের নেতাগোছের একজন চিৎকার করতে থাকে।

রাত ৩টা বেজে যায়, দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমাদের পা ধরে আসে, আমরা বসবার জন্যে স্কুল মাঠের পাশে একটা বড় আমগাছ খুঁজে বের করি; আর বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করি, রাত যত বাড়ে মানুষ যেন তত বাড়তে থাকে আর সকলের মুখে এক কথা- ‘হেলিকপটার আহুক আগে। দেহি, কেমনে একটা লাশ লয়া যায়!’

আমগাছের পেছনে আকস্মিক নারী কণ্ঠের তীক্ষ আর্তনাদে আমরা পেছন ফিরি, এক মধ্যবয়স্কা নারী কাঁদেন আর বলেন- ‘আফনেরা সংবাদিক। হোনেন। আমরার স্বামীরে পুলিশ ধরছে। পিডাইয়া আধ মরা কইরা ফালছে! তার কুনো দুষ নাই।’ জানতে পারি, তিনি, মর্জিনা বেগম নিহত মোনতাজ আখন্দের বাগানবাড়ির হেড গার্ড রহিম মিয়ার স্ত্রী; থানা থেকে খবর পেয়েছেন তার স্বামীকে পুলিশ এরইমধ্যে আচ্ছামতো পিটিয়েছে; মর্জিনা বলতে থাকেন, পুলিশ সাংবাদিকদের কাছে তথ্য গোপন করছেন, নিহত তরুণীর নাম দিশা, সে এর আগেও এসেছে মোনতাজ আখন্দের সঙ্গে বাগানবাড়িতে কয়েকবার; মর্জিনা একবার তাকে কলার থোড় আর চালের গুড়া দিয়ে পিঠাও বানিয়ে দিয়েছে; গেলবার ঢাকা থেকে আসবার সময় দিশা তার জন্যে শাড়ি, চুড়ি পর্যন্ত এনেছে; এ’যাত্রায় মোনতাজ আখন্দ আর দিশা বাগানবাড়িতে এসেছে গতকাল দুপুরে- পুলিশকে এ’সব তথ্য জানিয়েছে রহিম; তবে পুলিশ কেন এইসব তথ্য সাংবাদিকদের দেয় নাই? তার মানে, মর্জিনার ধারণা- পুলিশ বড় মানুষরে বাঁচানোর জন্য তার স্বামীকে ফাঁসাতে চায়!

বলে কি, এতো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য; আমাদের সাংবাদিক মন চঞ্চল হয়ে ওঠে, ওসি মোজাফ্ফরকে যতটা সরল মনে হচ্ছিল, সে তা নয়; তবে আমরা দিশার আরও বৃত্তান্ত জানতে অধীর হয়ে পড়ি, রহিমের বউ মর্জিনা বলে, ‘মোনতাজ সাবের বউ ওই মাইয়ারে চেনে! এই বাগানবাড়িতে একবার স্যার আর দিশা ম্যাডাম আইস্যা উঠছে শুক্কুরবার, বড় ম্যাডাম মানে মোনতাজ সাবের বউ পিছ পিছ আতকা আইসা হাজির। কী কা- হইলো সেইবার! ওসি মোজাফ্ফররে ডাইকা আনলো আমার স্বামী সেইবার। ’

‘আপনে এসব কথা ছাত্রদের কাউরে বলেন নাই? এখানকার নেতা যারা?’ আমাদের একজন মর্জিনাকে জিজ্ঞেস করে।

‘কইছি। শামসুল হকরে মোবাইল করছি। সে আছে এইখানে। সে বলছে, আমারে চুপ থাকতে।’

প্রত্যন্ত পলাশিহাটা হাই স্কুলের এই মাঠে প্রায় ২০ বছর আগে, ১৯৯৬ সালে একবার দেশের প্রধানমন্ত্রী আসেন বক্তৃতা দেবার জন্যে; এই সময়ের তরুণদের স্মৃতিতেও তা নেই; শিশু-কিশোররা তো হেলিকপ্টারের ছবিই দেখেছে কেবল; আর প্রৌঢ় বা বৃদ্ধরা সেই যে একবার কবে দেখেছে হেলিকপ্টার স্বচক্ষে; হতে যাওয়া আরেকবার হেলিকপ্টার-অভিজ্ঞতা তাদের সোনালি দিনে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে থাকে; হেলিকপ্টার রাত সাড়ে ৩টায় পলাশিহাটা স্কুলের মাঠে নামতে শুরু করে, পুলিশের সাইরেন, হ্যান্ডমাইকে ‘দূরে গিয়া খাড়ান’ আহ্বান, ধীরে ধীরে নেমে আসা স্বপ্নের সেই যান ও প্রচ- বাতাস আর শব্দ আর আসন্ন ‘কী হতে যাচ্ছে’ উত্তেজনায় ফুলবাড়িয়া উপজেলার আশপাশের গ্রাম- বাদিহাটি, বরখিলা, কাউয়ালাড়া, সন্তোষপুর কি নিশ্চিন্তপুরের কয়েক হাজার মানুষ ততক্ষণে রীতিমতো থরথর করে কাঁপতে থাকে। হেলিকপ্টার মাটিতে নেমে আসে, পাখাগুলো ঘুরতে ঘুরতে স্থির হয়; স্থানীয় এমপি, মেম্বর, ওসি, বিভিন্ন অফিসাররা হেলিকপ্টারের দিকে ছুটে যানÑ সমবেত জনতা তখনও স্থির ও সবিস্ময়ে দেখতে থাকেÑ হেলিকপ্টার থেকে নামে কয়েকজন; বোঝা যায়, এদের মধ্যে শাড়িপড়া মধ্যবয়স্কা নারী হচ্ছেন মোনতাজ আখন্দের স্ত্রী, ৪৫/৪৬ বছর বয়স, চশমাচোখে ঘোমটা মাথায় তিনি হেঁটে চলেন হাসপাতালের দিকে, তার পাশে তার কন্যা ২২/২৩ বছর বয়স হবে, মায়ের মতোই চেহারা তীক্ষ্ন, চোখে চশমা; মেয়েটির পাশে একজন পুরুষ, জানা যায়- তিনি মোনতাজ আখন্দের শ্যালক ও আরেকজন মাঝবয়সি ভদ্রলোক- তিনি মোনতাজ আখন্দের অসংখ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ একটির নির্বাহী- সবমিলিয়ে ৪ জন মোনতাজ আখন্দের লাশ গ্রহণের জন্যে হাসপাতালের মর্গের দিকে দ্রুত পা চালান; হেলিকপ্টার ঘিরে তখন কয়েক হাজার মানুষ, তাদের ঘিরে হাজার খানেক পুলিশ।

জনতা ঘিরে ধরে হাসপাতাল। লাশ দুইটাই হেলিকপ্টারে নিতে হবে। মর্গের ভেতরে কি হয়, দেখবার জন্যে আমরা কয়েকজন সাংবাদিক অনুরোধ করি ওসি মোজাফ্ফরকে, ‘ভাই, এতো দূর এসে যদি এইটুকু দেখতে না পাই…আমাদের ২জনকে ভিতরে যেতে দিন। ফটোগ্রাফার দরকার নাই, ছবি তুলবো না।’

প্রথমে আপত্তি করেন তিনি- তারপরও ওসি মোজাফ্ফর বুঝদার মানুষ, বুঝতে পারেন, আসন্ন উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সাংবাদিকদের সহায়তা তাদের লাগবে, বিশেষত ঢাকার সাংবাদিক, তিনি বলেন, ‘দুইজন যান আপনারা। ছবি তুলবেন না। প্লিজ। আমাদের দিকটা একটু দেখবেন। গ-গোল যেন না বাঁধে ভাই।’

আমরা হাসপাতালের দিকে এগোই; উপজেলা হাসপাতাল হলেও একেবারে অপরিসর নয়, ভেতরে সবুজ মাঠও আছে, মর্গটা পশ্চিম পার্শ্বে; আমরা মর্গের দরজার কাছে যাই; মোনতাজ আখন্দ আর ‘দিশা’ নামের সেই তরুণী পাশাপাশি দুটি ছোটখাটে, দু’জনেরই শরীর সাদা চাদরে ঢাকা, মুখ দুটো খোলা, বন্ধ চোখ। আমরা ভেবেছি, মোনতাজ আখন্দের স্ত্রী ও কন্যা দু’জনেই কান্নায় ভেঙে পড়বেন মোনতাজের লাশের উপর; না, সেরকম কিছু নয়, জলভারানত মুখে তারা গম্ভীর দাঁড়িয়ে রইলেন কয়েক মিনিট; নিঃশব্দে দুজনের চোখ দিয়েই জল গড়িয়ে পড়ে; তারা পারতপক্ষে ১টি বারও তাকালেন না দিশার দিকে, মা-মেয়ে দু’জনই; কয়েক মিনিট পর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীকে ডেকে, মোনতাজ আখন্দের স্ত্রী শাহানা আখন্দ, কান্নাভেজা অথচ কঠোর কণ্ঠে বলেন, ‘গ্রামের কয়েকটা মানুষকে হাত করতে কয় টাকা লাগে? এতো সময় লাগছে কেন আপনাদের? আমি তো ৩ ঘণ্টা সময় দিয়েছি আপনাদের! কেন এখনও এতো ক্রাউড!…ওই লাশ নিয়ে ঢাকায় গেলে আমি মুখ দেখাবো কেমন করে? মি.আখন্দকে নিয়ে আমরা এখুনই রওনা দেব। একটা সাউন্ড যেন না হয়…।’

‘ম্যাডাম। গ্রামদেশ। এখানে টাকার চেয়ে ইমোশন বেশি কাজ করে। বাই দ্য ওয়ে…তারপরও সব ম্যানেজ হয়েছে। আপনি আরেকটু সময় দেন। ওসি সাহেবের রুমে গিয়ে বসেন। আমরা বোধহয় একটু আরলি চলে এসেছি।’

‘খবর পেলাম ৬টায়। আসলাম রাত ৩টায়। তাও আরলি! আপনারা কি করলেন এতক্ষণ? টাকা দিয়ে মানুষ ম্যানেজ করা যায় না…আমাকে শেখান!’

‘জি ম্যাডাম’,‘জি ম্যাডাম’ বলতে বলতে মিসেস মোনতাজকে ওসি মোজাফ্ফরের কক্ষে নিয়ে যান নির্বাহী, সঙ্গে মোনতাজ আখন্দের কন্যা ও শ্যালক।

থানার সামনে তখন মানুষের জটলা ক্রমশ বাড়ে; ওদিকে হাসপাতালের মর্গে অপেক্ষিত পঞ্চাশ বছরের মধ্যবয়সি, খ্যাতিমান ব্যবসায়ী মোনতাজ আখন্দ আর ২২ বছরের অপরিচিতা এক অনিন্দ্য তরুণী দিশা- দু’জন আচমকা খুন হয়ে কত কত গল্প-অগল্পের সূত্র রেখে অতঃপর নিশ্চিন্ত ঘুমে বিভোর।

জীবিত মানুষ নিয়েই যত সমস্যা-সঙ্কট; মৃতেরা চিরকালই এ’সবের বাইরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.